সেন বংশ (sena dynasty)

সেনদের আদি বাসস্থান ছিল কর্ণাট অঞ্চল ( বর্তমান মহীশূর ) ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল । রাজশাহীর নিকটস্থ ‘ দেওপাড়া লেখ ’ থেকে জানা যায় যে , সেনরা জাতিতে ব্ৰহ্ম – ক্ষত্রিয় ছিলেন । যাঁরা ব্রাহ্মণ কুলে জন্মগ্রহণ করে একই সাথে ব্রাহ্মণ্য আচার এবং ক্ষত্রিয়ের পেশা রাজ্যশাসন ও যুদ্ধবিদ্যা অনুশীলন করে তাকে "ব্রহ্মক্ষত্রিয়" বলে। বীরসেন ছিল সেন রাজাদের পূর্বপুরুষ। বাংলায় সেনদের রাজনৈতিক ইতিহাস শুরু হয় সামন্ত সেনের আমল থেকে । তিনি বৃদ্ধ বয়সে রাঢ় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন । তবে তিনি কোনাে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেননি কিংবা রাজকীয় অভিধা নেননি ।

হেমন্ত সেন

  • সামন্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন পাল রাজাদের বিরুদ্ধে কৈবর্ত বিদ্রোহের সুযােগে রাঢ় অঞ্চলে একটি ক্ষুদ্র রাজ্য স্থাপন করেন ।
  • বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসনে সামন্তসেনের পুত্র হেমন্তসেনকে ‘মহারাজাধিরাজ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এই রাজকীয় উপাধি থেকে ঐতিহাসিকরা হেমন্তসেনকে সেন রাজবংশের প্রথম রাজা বলে আখ্যায়িত করেছেন। সম্ভবত তিনি পালরাংশীয় শাসনামলে একজন সামন্ত ছিলেন।
  • বিজয়সেনের ব্যারাকপুর তাম্রশাসনে হেমন্ত সেনকে ‘রাজরক্ষা সুদক্ষ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। একই শিলালিপিতে বিজয়সেনের মাতা যশোদেবীকে মহারাজ্ঞী উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।

বিজয় সেন (১০৯৫ খ্রিস্টাব্দ – ১১৫৮ খ্রিস্টাব্দ )

  • তিনি ছিলেন স্বাধীন সেন বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।
  • তিনি শূরবংশীয় রাজকন্যা বিলাসদেবীকে বিবাহ করে নিজের হাত শক্ত করেন ।
  • কৈবর্ত বিদ্রোহের সময় রাজা রামপালকে বরেন্দ্র উদ্ধারে সহযোগিতা করার বিনিময়ে বিজয় সেন স্বাধীনতার স্বীকৃতি পেয়েছিলেন।
  • তিনি সমগ্র রাঢ় অঞলে স্বাধীন সেন বংশের প্রতিষ্ঠা করেন ও “মহারাজাধিরাজ” উপাধি গ্রহণ করেন।
  • মিথিলার রাজা কর্ণাট দেশীয় নান্যদেব, বঙ্গদেশ দখল করতে আসেন। একই উদ্দেশ্যে বিজয়সেনও অগ্রসর হন। ফলে দখলদারিত্ব নিয়ে দু’জনের মধ্যে যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে নান্যদেব পরাজিত হয়ে বঙ্গ দখল করার আশা ত্যাগ করে মিথিলায় ফিরে যান।
  • তিনি মদন পালকে পরাজিত করে গৌড় বা উত্তরবঙ্গে এবং বর্মনরাজকে পরাজিত করে পূর্ববঙ্গে সেন শাসন প্রতিষ্ঠা করেন ।
  • পশ্চিমবঙ্গে বিজয়পুরে তিনি একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন।
  • তার অপর একটি রাজধানী ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে।
  • তাঁর সভাকবি ছিলেন উমাপতি ধর ও শ্রীহর্ষ।
  • পরমেশ্বর, পরম মাহেশ্বর, পরমভট্টারক মহারাজাধিরাজ, অবিরাজ-বৃষভ-শঙ্কর প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেন।
  • শ্রীহর্ষভট্ট রচিত ‘ বিজয় প্রশস্তি ’ ও ‘ গৌড়ধীশ কুল প্রশস্তি ’ বিক্রমপুরের তাপট , উমাপতি ধরের “দেওপাড়া লিপি” প্রভৃতি থেকে তার রাজত্বকাল সম্পর্কে জানা যায়।

বল্লাল সেন (১১৫৮ – ১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ)

  • পিতা বিজয় সেনের মৃত্যুর পর বল্লাল সেন সিংহাসনারােহণ করেন।
  • তিনি মহারাজাধিরাজ, গৌড়েন্দ্র-কুঞ্জরালাল-স্তম্ভবাহুর্মহীপতি, অরিরাজ-নিঃশক-শংকর প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেন।
  • তিনি চালুক্যরাজ দ্বিতীয় জগদেকমল্লের কন্যা রমাদেবীকে বিবাহ করে সেনবংশের সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন।
  • এই সময় বাংলাদেশ বঙ্গ, বরেন্দ্র, রাঢ়, বাগদী ও মিথিলা — এই 5 টি অংশে বিভক্ত ছিল।
  • বল্লাল সেনের আমলে মালদহের সন্নিকটে গৌড় নগর নির্মিত হয় এবং পুত্র লক্ষণসেনের নামানুসারে গৌড়ের নামকরণ হয় – “লক্ষণাবতি”।
  • অনিরুদ্ধ ছিলেন বল্লাল সেনের গুরু।
  • তাঁর রচিত উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ ছিল “দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর” (অদ্ভুতসাগরের শেষাংশ পুত্র লক্ষ্মণ সেন রচনা করেন)।
  • নবদ্বীপের শাসক বুদ্ধিমন্ত খাঁর নির্দেশে আনন্দভট্ট বল্লাল সেন সম্পর্কে “বল্লাল চরিত” নামক গ্রন্থটি রচনা করেন।
  • বল্লাল সেন ছিলেন কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তক । ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থ —এই তিন শ্রেণির মধ্যে তিনি কৌলিন্য প্রথার প্রবর্তন করেন।
  • তিনি শৈব ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বৈষ্ণব ধর্মেরও অনুরাগী ছিলেন।

লক্ষ্মণ সেন (১১৭৯ খ্রিস্টাব্দ – ১২০৫ খ্রিস্টাব্দ)

  • বল্লাল সেন সংসার ধর্ম ত্যাগ করলে 60 বছর বয়সে লক্ষ্মণ সেন সিংহাসনারােহণ করেন ।
  • তাঁর রাজত্বকালের কয়েকটি তাম্রশাসন , সভাকবিদের রচিত প্রশস্তি ও মুসলমান ঐতিহাসিক মিনাজউদ্দিনের লেখা ‘ তবকৎ – ই – নাসিরী ’ ইত্যাদি গ্রন্থ থেকে লক্ষ্মণ সেনের রাজত্বকালের সংক্ষিপ্ত পরিচয় পাওয়া যায় ।
  • তার উপাধি ছিল গৌড়েশ্বর, অরিরাজ মর্দনশংকর, পরমবৈষ্ণব।
  • তাঁর রাজধানী ছিল নদীয়াতে।
  • গহড়বালরাজ জয়চন্দ্রকে তিনি পরাজিত করেছিলেন।
  • মিনহাজউদ্দিন সিরাজ -এর “তবাকৎ-ই-নাসিরী” সরণথ থেকে জানা যায় ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে কুতুবুদ্দীনের সেনাপতি ‘ইখতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খলজি” বিহার জয় করে ওদন্তপুরী বিহারটিকে ধ্বংস করেন।
  • লক্ষ্মণ সেনের আমলের উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার – উদ্দিন – মহম্মদ – বিন বখতিয়ার খলজির আক্রমণ । ১২০১ খ্রিস্টাব্দে বখতিয়ার খলজির অতর্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে গােপনে তিনি পূর্ববঙ্গে পালিয়ে যান ।
  • লক্ষ্মণ সেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুর থেকে পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গ শাসন করতেন।
  • বল্লাল সেনের অসমাপ্ত ‘অদ্ভুতসাগর’ গ্রন্থটি তিনি সমাপ্ত করেন।
  • তাঁর সময়ে সাহিত্যক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। তাঁর রাজসভায় ‘পঞরত্ন’ ছিলেন- উমাপতি ধর, ধোয়ী ( পবনদূত রচয়িতা ), জয়দেব( গীতগোবিন্দ রচয়িতা, জয়দেব ছিলেন লক্ষণসেনের সভাকবি ), শরণ, গোবর্ধন ( আর্যসপ্তশতি রচয়িতা )।
  • হলায়ুধ ছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রী। তিনি (লক্ষণ সেন) “লক্ষণসম্বৎ” প্রবর্তন করেন। মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ তাঁকে ‘হিন্দুস্তানের খলিফা’ বলে অভিহিত করেছেন।

লক্ষণ সেনের পরবর্তীতে বিশ্বরূপ সেন রাজত্ব করেছিলেন, যিনি লক্ষণাবতীর সুলতান গিয়াসউদ্দিন আয়াজকে পরাজিত করেন। তার পরবর্তীতে কেশব সেন – এর সময়ে সেন রাজবংশ পূর্ববঙ্গেই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। বিশ্বরূপসেনের তাম্রশাসনে সূর্যসেন ও কুমার পুরুষোত্তম সেনের নামের উল্লেখ আছে। সম্ভবত এঁরা বিশ্বরূপসেনের পুত্র ছিলেন। তবে তাঁদের কেউ রাজত্ব করেছিলেন কিনা তা জানা যায় না।